সাড়ে ছয় হাজার ফুট উঁচুতে এক গ্রামে

‘আমরা আজ ২ হাজার ২০ মিটার ওপরের একটা গ্রামে যাব। পায়ে হেঁটে!’

কুমার থাপার কথা শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেল। আমি মোটামুটি অলস ও নন-অ্যাডভেঞ্চারাস প্রকৃতির পর্যটক। সমুদ্র দেখতে গিয়ে সাধারণত সমুদ্রে নামি না, ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়ি আর সমুদ্রের এলোমেলো বাতাস উপভোগ করি। বেড়াতে গিয়ে রাফটিং, বাঞ্জি জাম্পিং বা প্যারাগ্লাইডিং জাতীয় কর্মকাণ্ডে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। তেমনি পাহাড় দেখতে গিয়ে পাহাড়েই উঠতে হবে, এমনটাও কখনো ভাবিনি। মিন মিন করে বলতে চেষ্টা করলাম, ‘মানে হাঁটা ছাড়া আর কোনো পথ নাই?’

শুনলাম ‘কম হাঁটা’র একটি বিকল্প পথ আছে। কিন্তু সে পথে উঠলে আবার বিকেল পাঁচটার মধ্যেই ফিরতে হবে, তাহলে গ্রামে সময় কাটানোর মতো সময় পাওয়া যাবে অল্প। তাই আমার ছেলেমেয়েরা সেই বিকল্প পথের আইডিয়া বাদ দিয়েছে! তারা ‘বেশি ঘুরপথে’ই উঠতে চায়!

পোখারা থেকে ঘোর-প্যাঁচ পাহাড়ি রাস্তা ধরে খাড়া ওপরে উঠছিল আমাদের জিপ। সেই রাস্তার এক ধারে ঘন সবুজ পাহাড়, অন্য ধারে হাজার হাজার ফুট নিচে ফেলে আসা মোহময় ফেওয়া হ্রদ। আমাদের ডান পাশ ঘেঁষে বয়ে চলেছে খরস্রোতা মাদি নদী। আরেকটু ওপরে উঠে বাঁয়ে পড়ল সুন্দর এক জলপ্রপাত। ওটা পেরিয়েই অন্নপূর্ণা রেঞ্জের প্রবেশপথ, পর্যটকদের এখানে পাসপোর্ট ও পারমিট দেখাতে হয়। এখানে চেকিং শেষে আরও খানিকটা পথ গেলে গাড়ি চলাচলের রাস্তা শেষ। একেই বলে ‘রোড টু দ্য এন্ড’। এবার পা দুটোই ভরসা।

যেখানে আমরা থেমেছি, সেখান থেকেই অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পের অভিযাত্রীরা যাত্রা শুরু করবেন ডান দিকের ট্র্যাক ধরে। আর ঘানদ্রুক গ্রামে যেতে উঠতে হবে সোজা পাহাড় বেয়ে ওপরে। কখনো কখনো অভিযাত্রীরাও গ্রামটা দেখে যান কৌতূহলের বশে। কুমার থাপা উৎসাহ দিল, ‘আরে তুমি পারবে! এটা কোনো ব্যাপারই না। শুরু করলেই শেষ।’ ঘণ্টি বাজিয়ে ঘোড়ার পাল পাশ কাটিয়ে গেল টগবগ করে

গাড়ি নিচে রেখে অবশেষে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। পাথুরে পাহাড়ি পথ। দুই ধারে ঘন সবুজ গাছপালা, নানা জাতের ফার্ন, মাঝেমধ্যে নাম না জানা পাহাড়ি অর্কিড আর নানা রঙের ফুল। ফুলের এত তীব্র রং আগে দেখিনি। পথ কোথাও উঠে গেছে খাড়া, কোথাও আবার কিছুটা সমতল। কখনো বড় কোনো গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে, পেছনের ব্যাগ থেকে পানির বোতল নিয়ে খাচ্ছি ঢকঢক করে। মৃদু হিমেল হাওয়া শরীর–মন জুড়াচ্ছে। গত রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য চারদিকে এমন ‘অসহ্য সবুজ’। সর সর করে দুলতে দুলতে যেন গান গাইছে পাহাড়ি ফার্ন। কান পাতলে অনেক নিচ থেকে ভেসে আসে মাদি নদীর কুল কুল ধ্বনি। চারপাশে বৃষ্টিভেজা সোঁদা গন্ধ। জীবনানন্দের কথায় বলতে গেলে, ‘চারিদিকে বড়ো বড়ো আকাশ ও গাছের শরীরে, সময় এসেছে তার নীড়ে’।

সত্যি, পাহাড়ের বুকে আকাশটাকে এত বড় দেখায় কেন? হঠাৎ কানে এল টুং টুং ঘন্টির শব্দ। কী ওটা? কুমার থাপা বলল, ‘ঘোড়ার দল নিয়ে চলেছে কেউ। এখানকার কেউ কেউ ফলপাকুড়, বাঁধাকপি, গম বা ভুট্টা, দুধ বিক্রি করতে নিয়ে যায় নিচে লোকালয়ে, ঘোড়ার পিঠে বেঁধে।’ ঘোড়াদের পথ ছেড়ে দিতে হলো। ঘণ্টি বাজিয়ে ঘোড়ার পাল পাশ কাটিয়ে গেল টগবগ করে। আরও বেশ খানিকটা যেতে পথে পড়ল বিশাল এক পামগাছ। থরে থরে ধরে আছে টসটসে লালচে প্লাম। দেখেই তৎপর কুমার থাপা আর আমাদের গাড়িচালক অনিল বিশ্বকর্মা। একটা লাঠি জোগাড় করে মহা উৎসাহে পাড়তে লাগল প্লাম, আর আমরা শিশুর মতো আনন্দে তা কুড়িয়ে বা ক্যাচ ধরে নিতে থাকলাম। মুখে দিতেই অবিস্মরণীয় স্বাদ। এতক্ষণ পাহাড় বেয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম, পায়ের পেশি টনটন করছিল, ঘামে ভিজে গেছে জামা। এখন পাহাড়ি সুস্বাদু প্লাম খেয়ে যেন নবশক্তি ফিরে পেলাম। আসলে এই ফলে আছে প্রচুর পটাশিয়াম আর জলীয় অংশ। রেডি গ্লুকোজও মিলল এ থেকে। ফলে নতুন উদ্যমে আবার হাঁটা শুরু করলাম চড়াই-উতরাই পেরিয়ে। কিন্তু পথ যে ফুরায় না। আর কত? শেষ পর্যন্ত পাহাড়ি পথের চূড়ায় গিয়ে দূরে দেখা মেলে ছোট ছোট পাথরের বাড়ি। ওই তো! পেয়ে গেছি ঘানদ্রুক গ্রাম। হাঁটতে হলো আরও বেশ খানিকটা পথ।

হিমালয়ের কোলের ছোট্ট প্রাচীন গ্রাম ঘানদ্রুকছবি: লেখকের সৌজন্যে
গ্রামের নাম ঘানদ্রুক
ঘানদ্রুক গ্রাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ফুট ওপরে। হিমালয়ের কোলের ছোট্ট প্রাচীন গ্রামটি বিশ্বের অন্যতম এক উচ্চ জনবসতি। ৪০০ বছর ধরে গুরুং সম্প্রদায় এই গ্রামের অধিবাসী। গুরুংরা যোদ্ধা জাতি। অসম সাহস আর শৌর্যের জন্য সেনাবাহিনীতে তাদের কদর ভিন্ন। এই গ্রামেরও অনেকে আছেন সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা বাহিনীতে।

গ্রামে সারি সারি পাথর আর কাদামাটির তৈরি ধূসর বাড়ি। বাড়িগুলোর মধ্য দিয়ে সংকীর্ণ পাথুরে গলি। কোথাও এক চিলতে জমিতে আলুর ফলন হয়েছে। ভুট্টা, বাঁধাকপিও। ভুট্টা জাঁতাকলে পিষে করা হয় ছাতু। আর বাঁধাকপি আলুর তরকারি। এই হলো খাবার। খেতের শর্ষে থেকে তৈরি হয় তেল। আর পাথর থেকে আসে হিমালয়ান রক সল্ট। ব্যস, আর কী লাগে? দিব্যি পেট চলে। শুনে অবাক হই—প্রোটিন? প্রোটিন খায় না বুঝি তারা? কুমার থাপা গোয়ালঘর দেখায়, ওই যে বড় বড় মহিষ। দুধ হয় প্রচুর। আর মহিষের দুধের ঘন দই। যা খায়, নিজেরাই ফলায় বা তৈরি করে। এত ওপর থেকে নিচে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করার সুযোগ নেই। টাকাও নেই। কী সহজ-সরল জীবন। আর এই খেয়ে এদের এত স্ট্যামিনা! যে পথ আমরা উঠে এলাম দুই ঘণ্টায়, তা নাকি এদের নিত্য ২৫ মিনিটের ওঠা-নামা!

ঘানদ্রুক গ্রামে সারি সারি পাথর আর কাদামাটির তৈরি ধূসর বাড়ি
ঘানদ্রুক গ্রামে সারি সারি পাথর আর কাদামাটির তৈরি ধূসর বাড়িছবি: লেখকের সৌজন্যে
সুন্দর গ্রামটা ঘুরে ঘুরে দেখি। এক্কেবারে চোখের নাগালে এসে ধরা দেয় অন্নপূর্ণাসহ বিশাল গম্ভীর হিমালয়। আকাশটাও যেন কত কাছে। দূরে দূরে পাহাড়ের কোলে আরও ছোট ছোট জনবসতি দেখা যায়। আর অনেক অনেক নিচে ফেলে এসেছি মাদি নদী, যার ধার থেকে আমরা এই যাত্রা শুরু করেছিলাম। সহাস্যে আমাদের অভ্যর্থনা জানায় গ্রামবাসী। কোনো কোনো বাড়ি পর্যটকদের জন্য গেস্টহাউস করা হয়েছে। অ্যাডভেঞ্চারাস পর্যটকেরা এই সুউচ্চ গাঁয়ে এসে কয়েক দিন পাহাড়ের কোলে কাটিয়ে যান। থাকতে হবে এই পাথুরে ঘরে, জোঁক আর সাপের ভয় তো আছেই। আর রেডি খাবার মিলবে না, পাহাড়িদের মতোই স্থানীয় উপাদান সংগ্রহ করে রান্না করে খেতে হবে।

সূর্য পশ্চিমে গড়ালে এবার নামবার পালা। কুমার থাপা রসিকতা করে বলল, ‘এই তো বেশ কত ওপরে উঠে গেছ! দুদিন এখানে থাকো, ওঠানামা করো এদের মতো, তাহলে এভারেস্টসুদ্ধ জয় করে ফেলবে!’

শুনে কপট রাগ দেখাই, ‘হুম বলছে তোমাকে!’

বিকেলের ম্লান আলোয় আমরা এবার নামতে শুরু করলাম। নামতে নামতে ৭২ বছর বয়সী টেক বাহাদুরের সঙ্গে দেখা। পিঠে বাঁধা ঝুড়িতে জমিতে ফলানো ব্রকলি নিয়ে লোকালয়ে বিক্রি করতে চলেছে লোকটা। বিক্রি করে যে পয়সা পায়, তা মদিরা খেয়েই উড়িয়ে দেন, বলল কুমার থাপা। ছেলেমেয়ে আছে বটে, তবে তাঁরা তাঁর খোঁজ রাখেন না তেমন। এই বুড়ো বয়সে তাই তাঁকে রোজ পাহাড় বেয়ে নামতে আর উঠতে হয়। কিন্তু বৃদ্ধ লোকটার হাসিমুখ দেখে মনে হলো না এ নিয়ে তাঁর কোনো দুঃখ আছে।

আমাদের দলের মনোবিদ তাঁর স্বভাবসুলভ প্রশ্ন করলেন, ‘মনে দুঃখ হলে কী করেন?’

শুনে টেক বাহাদুর অবাক, ‘দুঃখ? দুঃখ কেন? না না, কোনো দুঃখ-কষ্ট নাই মনে।’

শুনে আমরা আরও অবাক। সে কী! কীভাবে?

ঘানদ্রুক গ্রামের এক নারী
ঘানদ্রুক গ্রামের এক নারীছবি: লেখকের সৌজন্যে
বুড়ো ফোকলা দাঁতে হাসেন, ‘শোন, কারও কাছে কিছু চাওয়ার নেই জীবনে। আর চাওয়া না থাকলে কোনো দুঃখও নেই! সহজ।’

শেষ বিকেলের আলোয় টেক বাহাদুরের কথা ভারী অদ্ভুত লাগে। সুখী হওয়ার এই জীবনদর্শন কী আশ্চর্য সরল! মনে পড়ে, দুদিন আগে বৌদ্ধনাথ প্যাগোডার সামনে থাংকা চিত্রকর দিক্সেন বলছিলেন, ‘“ভালো” আর “মন্দ”র নিখুঁত ভারসাম্যই হ্যাপিনেস বা সুখের রহস্য।’

এতক্ষণে সুউচ্চ হিমালয়ের পেছনে সূর্য ডুবছে। মাদি নদীর জল যেন নেউল ধূসর, জলপাই অরণ্যের ওই পারে পাহাড়ের নীলিমা। এই আশ্চর্য প্রকৃতির সাম্রাজ্য ফেলে ফিরে চলেছি তাহলে। মনে পড়ে, জীবনানন্দ বলেছেন, ‘পৃথিবীর পথে গিয়ে আর কাজ নেই!’

টেক বাহাদুর শেষ পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে এলেন। হাসিমুখে বিদায় জানালেন।

বললাম, ‘দেখা হবে।’

শুনে তাঁর হাসি আর থামে না, ‘এই এক জীবনে কতজনের সঙ্গে দেখা হলো, কতজনকে বিদায় দিলাম। তারা বলল আবার দেখা হবে। কই, তারা তো আর ফিরে এল না! আচ্ছা, এত এত মানুষ, তারা কোথায় থাকে? কোথায় চলে যায়?’

এই হিমালয়ের বাইরে যে এক বিশাল পৃথিবীও আছে, টেক বাহাদুর তা কল্পনাই করতে পারেন না। আর আমরাই যে পৃথিবীর পথে পথে পদচিহ্ন ফেলে যাই, আমাদের গন্তব্যই কি আমরা জানি?