পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এম কে পারভেজ :
আজ ২ ডিসেম্বর। ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর পূর্তি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যা পার্বত্য চুক্তি নামে পরিচিত।
এ কথা অনস্বীকার্য যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাল্টে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি। অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে নেমে আসে শান্তির বার্তাবরণ। শুরু হয় উন্নয়ন কার্যক্রম। জনজীবনে ফিরে এসেছে স্বাভাবিক অবস্থা, পাল্টে গেছে জীবনধারা। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য, পাহাড়ি-বাঙালির জীবনে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া।
পার্বত্য চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দুই যুগের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামার অবসান ঘটিয়ে শান্তি উন্নয়ন ও সম্প্রীতির পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়ে তুলতে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পার্বত্য চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বিগত ২৭ বছরে বেশ কিছু পদক্ষপে গৃহীত হয়েছে। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দপ্তর-সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পিত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন। ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি পাহাড়ি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের নির্ধারিত কোটা অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্থ-সামাজিকভাবেও উন্নয়ন হয়েছে। বহু উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ৫০৭ কিমি (৩৩কেভি), ৯৮৩ কিমি (১১কেভি) এবং ১,৩৫৫ কিমি (৪কেভি) বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। দুর্গম হওয়ার কারণে যেখানে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয়, এ রকম পাঁচ হাজার ৫০০টি পরিবারকে সৌর বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
প্রতি উপজেলায় সু-শিক্ষা নিশ্চত করার লক্ষ্যে স্কুল-কলেজ নির্মাণ করা হয়েছে উচ্চ শিক্ষার জন্য বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে জারিকৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১ প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়েছে।
পার্বত্য চুক্তির আগে পার্বত্য অঞ্চলে মাত্র ২০০ কিলোমিটার রাস্তা ছিল। এখন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় নির্মাণ করেছে এক হাজার ৫৩২ কিলোমটিার পাকা রাস্তা ও ৪৫টি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। চট্টগ্রাম বন্দর ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি সহজতর করতে রামগড় স্থল বন্দরের অবদান অন্যতম। এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন দ্রুত ও সহজতর করতে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশস্ত করা হচ্ছে বারইয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক। এছাড়াও প্রায় ১০৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের আওতা বৃদ্ধি এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা হয়েছে, যা পার্বত্য চুক্তির আগে ছিল না বললেই চলে। চুক্তির আলোকে পার্বত্য জেলায় কৃষি, স্বাস্থ্য, নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি বেশকিছু এলাকা পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধীভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি চালু করা হয়েছে। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের আওতায় দারিদ্র্য বিমোচন তথা জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের অদূরে শালবনের রসুলপুর এলাকায় ৫ একর জায়গায় ১৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ কতৃক পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় চুক্তির আলোকে পার্বত্য জেলায় বেশকিছু এলাকা পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে, যা এখন দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের জায়গায় পরিণত হয়েছে। এছাড়াও পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নে বর্তমানে হাজার কোটি টাকার উন্নয়নন কাজ চলমান রয়েছে।
কিছু নিতান্তই দুর্গম এলাকা বাদ দিলে ছোট ছোট বাড়ির ছাদে দেখা যাবে ‘আকাশ’ ডিশ এন্টেনা, টেলিভিশনের রঙিন বাক্স কিংবা মোবাইল ফোনে পরিবর্তিত জীবন। রঙিন পোশাকে লাইন ধরে স্কুলে যাচ্ছে ছোট্ট শিশুরা। বাজার-ঘাটে ঘুরলেই দেখা যায়, নগর জীবনের ছাপ লেগেছে প্রত্যন্ত এ পাহাড়ি অঞ্চলেও। অথচ এমন একটা সময় ছিল- বিকেল ৪টায় নেমে আসত মধ্যরাতরে অন্ধকার। চলাচল বন্ধ, শঙ্কা আর আতঙ্ক চারদিকে।
গুলি আর পাল্টা গুলির শব্দ রাতভর। ২ যুগে সময়টা পাল্টেছে। অন্ধকারে এখন আলোর ছোঁয়া। উন্নয়নের আলোকস্পর্শ পাল্টে দিয়েছে সব কিছু। এরপরও এ চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্কের শেষ হয়নি। চুক্তির এত বছর পর এসেও চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য সরকারকে দোষারোপ করতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অপর দিকে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পাহাড়িদের সশস্ত্র সংগঠনের লড়াইয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড়। চুক্তির পর গত ২৭ বছরে পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপের সংঘাত ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে অন্তত সাড়ে ৭ শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়াও এদের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।
সব প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে বিগত ২৭ বছরে পার্বত্য চুক্তির ৯৮টি উপধারার মধ্যে ৮৬টি উপধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। চুক্তির অবশিষ্ট ০৪টি উপধারা আংশিক এবং ৮টি উপধারা বর্তমানে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শান্তি চুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় শান্তি আনয়নের পাশাপাশি ওই এলাকায় অবকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধনের মাধ্যমে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানোন্নয়নে সরকার যথেষ্ট সচেষ্ট রয়েছে।
সরকারের আন্তরিকতা ও অব্যাহত প্রচেষ্টার কারণে পার্বত্য চুক্তির পর হতে এ যাবতকাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। চুক্তির সুফল হিসেবে সমতলের জেলাগুলোর মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোর সাধারণ মানুষ সকল সুবিধা ভোগ করছে। যা অতীতের পার্বত্য চট্টগ্রাম আর এখানকার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। সবমিলিয়ে বলা যায় সরকারের সদিচ্ছায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে পাল্টে গেছে পাহাড়ের দৃশ্যপট।