অনিয়ম অভিযোগের পাহাড় নিয়েও স্বপদে বহাল প্রগতির এমডি

এম আর আমিন :

নানা অনিয়ম ও স্বৈরাচারীর অভিযোগে ছাত্র-জনতার লাগাতার আন্দোলন ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলের অবসান হলেও রাহুমুক্ত হয়নি প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। পতিত সরকারের মন্ত্রীর পুত্র ও যুবলীগ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট সেনা বাহিনীর কালো তালিকাভুক্ত ’কেয়া মটরস’ থেকে গাড়ি আমদানির আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় থাকলেও তৎকালীন সরকার কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি পদে পুরস্কৃত করা হয়েছিল বলে বলে অভিযোগ আছে। দুর্নীকির মুলোৎপাটনের লক্ষে সরকার পতনের পর একজন সৎ মেধাবী ব্যক্তি ও মানবাধিকার সংগঠক আদিলুর রহমানের হাতে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারনে অভিযোগের পাহাড় মাথায় নিয়ে এখনো আওয়ামী লীগের সেই আশীর্বাদপুষ্ট দুর্নীতিবাজ এমডি বহাল তবিয়তেই আছেন। এমনকি উপদেষ্টার সাথে আঁতাত করে এই পদটিকে পাকাপোক্ত করার জন্য বিভিন্নভাবে তদবীর করছেন বলেও সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশ্বস্ত সুত্রে যানা গেছে।

সুত্র জানায়, পতিত সরকারের শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের বড় স্ত্রীর বড় ছেলে নুরুল মাহমুদ সাদীর সাথে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কালাম আজাদের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রগতির এমডি যুবলীগের ক্যাডার সাদীর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আর অনিয়মের টাকার ভাগ পেতেন মন্ত্রী ও তার ছেলে সাদীসহ একটি সিন্ডিকেট।
আবুল কালাম আজাদ চট্টগ্রামে ইস্টার্ন ক্যাবলস্ এ চাকরি করা অবস্থায় কোটি কোটি টাকার স্ক্র্যাপ মালামাল বিক্রয়ে দুর্নীতের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ওইসময়ে অভিযোগের তদন্ত কমিটি গঠন হলেও মন্ত্রীপুত্র সাদীর সাথে ঘনিষ্টতা থাকার কারণে বিচার না করেই প্রগতির ইন্ডাস্ট্রিজের ভারপ্রাপ্ত এমডি করা হয়েছিল। বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামানের নিকট অভিযোগপত্র প্রদানের পর তিনিও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
আবুল কালাম আজাদ একজন নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তা হয়েও সাদীর ক্ষমতায় সহকারী হিসাব রক্ষক থেকে একটি অটোমোবাইল টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠানের এমডি (ভারপ্রাপ্ত) পদে আসীন হন।
এই পদে বসেই নিজের আখের গোছাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। একটি প্রকল্প, ১৫১/১৫২ তেজগাঁও শিল্প এলাকার আঞ্চলিক বিক্রয়/বিতরণ কেন্দ্রে পাকিস্তান আমলের রেখে যাওয়া পুরাতন শেডের স্টীল স্ট্রাকচারের বারগুলো রং করে শুধু উপরে নতুন টিন দিয়ে মেঝেতে ৩/১ অংশ টাইলস ফিটিং করে, দুইটি টয়লেট নির্মাণ বাবদ ৮০ লক্ষ টাকা বিল করেন। ৪টি গাড়ী রাখার একটি শো-রুম ঘষামাঝা করে, গ্লাস, সাটার ফিটিং করে তাকে উদ্বোধনের ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা আপ্যায়ন ও কয়েকটি গাছ রোপনে ব্যয় দেখান।
হঠাৎ করে ফিজিবিলেটি স্টাডি না করেই ঢাকার তেজগাঁও একটি ওয়ার্কসপ নির্মাণ, তৎসঙ্গে ইকুয়েপমেন্ট ক্রয় বাবদ ১৫ কোটি টাকার একটি অলাভজনক প্রকল্প গ্রহণ করেন। মোটা অংকের কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে ওই প্রকল্পে।
কৃষি অধিদপ্তরের পার্টনার প্রজেক্টের ১৩৫ টি মিৎসুবিসি এল-২০০ মডেলের ডাবল কেবিন পিকাপ গাড়ীর ক্যারীবিয়, মালামাল, মাস্টার কিট বক্স রিফেকটর মেশিন এনলিষ্টেড বিহীন ভৌতিক একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সিন্ডিকেট তৈরী করে অফিসের কিছু কর্মকর্তা/কর্মচারীর সহযোগীতায় ক্যানপি এলসি করেন। অন্যান্য এনলিষ্টেড সরবরাহকারীদের দরের থেকে অতিরিক্ত বাজার দর প্রস্তুত করে মালামাল ক্রয় করার অভিযোগ রয়েছে। ওই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এ৭৩ (স্যামসাং) ১৩৫টি মোবাইল ক্রয় কার্যক্রম অফিসার আশিকুর রহমান সুমনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেন।

জাপানি মিংগুবিসি এল-২০০ ডাবল কেবিন পিকাপ বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় এবং টেকসই, সেই কোম্পানীর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঠিক না রেখে দক্ষিণ কোরিয়ান কেয়া মটরসের দিকে ঝুকে পড়েন। সাবেক শিল্প মন্ত্রীর পুত্রকে খুশি করতে বাংলাদেশ সেনাবাহীনির কালো তালিকাভূক্ত ’কেয়া মটরস’ এর সাথে ব্যবসা শুরু করেন। তবে লিখিত চুক্তি না করে মৌখক আলোচনার মাধ্যমে ৪০ টি সেভান গাড়ী ক্রয় করে যার বর্তমান আনুমানিক বাজার মূল্য ৩০ লাখ টাকার পরীবর্তে প্রায় ৪০ লাখ টাকার চুক্তি করেন। বাজারে এসব গাড়ির কোন চাহিদা নেই, অথচ উচ্চমুল্যে ক্রয় করা এসব গাড়ি নিয়ে বিপাকে পড়বে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ। সাবেক শিল্পমন্ত্রীর পুত্র, বিএসইসি চেয়ারম্যান, এমডি আবুল কালাম আজাদসহ একটি গ্রুপ দক্ষিণ কোরিয়ান কেয়া মটরস ফ্যাক্টরী পরিদর্শনের নামে পারিবারিক ও আনন্দ ভ্রমণ করে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করেন। যেখানে প্রতিষ্ঠানের ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিশিয়ানদের যাওয়া প্রয়োজন ছিল কিন্তু রাখা হয়নি।
গত ২১ মার্চ সাবেক শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ ও তার ছেলে যুবলীগ নেতা নুরুল মাহামুদ সাদীর নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়ার এসটিএক্স করপোরেশনের সঙ্গে নিম্নমানের গাড়ি আমদানির চুক্তি করেন প্রগতি। এ চুক্তিতে শিল্পমন্ত্রীর পরিবারের কয়েকজন সদস্য, বিএসইসির চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান বাদল, প্রগতির এমডি আবুল কালাম আজাদ ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা এস আলম উপস্থিত ছিলেন। তবে এসব চুক্তিতে প্রগতি বা বিএসইসির কোনো প্রকৌশলী থাকার কথা থাকলেও কাউকে রাখা হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে শ্রমিকদের পক্ষে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন নজরুল ইসলাম।

তবে অভিযোগের বিষয়গুলো অস্বীকার করে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ’আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা। কেয়া মটরস সেনাবাহিনীর কালো তালিকাভুক্ত কিনা তা আমার জানা নেই। চুক্তির সময় প্রকৌশলী রাখা হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ততার অযুহাতে পরে কথা বলবেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন’।