হৃদয় নিংড়ানো কথামালা
মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরীর এক ভিন্নধর্মী কাব্যগ্রন্থ ‘সুনন্দ সিন্দুক’। বইটিতে রয়েছে ৬০টি কবিতা যার প্রতিটিই ছোট ও সহজ কিন্তু প্রাণবন্ত। এমন কবিতা যখন লেখকের হৃদয় নিংড়ানো হয় তখন জনপ্রিয়তা পায় সর্বত্রই। এক মগ কফি পান করতে করতেই শেষ করে ফেলতে পারেন পুরো কাব্যগ্রন্থটিই। কিন্তু কফির চেয়ে আপনাকে আরও সতেজ করে তুলবে কবিতাগুলো এবং কফি শেষ হয়ে গেলেও কবিতাগুলোর রেশ শেষ হবে না। জাপানি হাইকু তিন পংক্তির ১৭ মাত্রায় সাধারণত লেখা হয়। সবদেশেই এখন হাইকুর অনুশীলন হচ্ছে। পংক্তি ও মাত্রায় সীমাবদ্ধ না থেকেও লেখক হাইকুর স্বাদ এনেছেন কবিতাগুলোতে। সাদত হাসান মান্টোর ‘কালো সীমানা’গল্প গ্রন্থেও আমরা দেখি এমন অতি অনুগল্প। পাঁচ/সাত শব্দে বা লাইনে গল্প শেষ! সম্প্রতি পড়লাম ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান তরুণী কবি রূপি কউর এর এমন একশো কবিতা। কবিতাগুলো বিশ্বজুড়ে পঠিত হচ্ছে। কবিতাগুলো পাঁচ/সাত শব্দে বা পংক্তিতে সীমাবদ্ধ কিন্তু সরল ও প্রাণবন্ত। সেখানে নারীর চোখ দিয়েই প্রকাশ করেছেন পুরুষের প্রতি নারীর উপলব্ধি। আর ‘সুনন্দ সিন্দুক’কাব্যগ্রন্থে নারীর প্রতি পুরুষের উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছে। এ উপলব্ধি কোমল, মায়াবী, হৃদয়গ্রাহী ও স্নিগ্ধতায় ভরপুর।
সুনন্দ হল আনন্দজনক। সুনন্দ সিন্দুক হতে পারে একজন সুন্দর স্বভাবের মানুষের হৃদয়। আনন্দদায়ক সেই সিন্দুক থেকে বেরিয়ে এসেছে হৃদয়স্পর্শী কথামালা। প্রতিটি কবিতার উপরেই রয়েছে প্রাসঙ্গিক অলংকরণ। বইটির মনোরোম প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন আনোয়ার সেলিম। ২০২২ একুশে গ্রন্থমেলায় ঝুমঝুমি প্রকাশন বইটি মেলায় এনেছে। প্রথম ফ্ল্যাপে ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক পাশা মোস্তফা কামাল কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে প্রাথমিক মূল্যায়ন করেছেন। নূহ-উল-আলম লেনিন যথার্থই বলেছেন, “তার কবিতায় আছে অন্তর্লীন গভীর বেদনাবোধ ও ক্ষোভ, আছে তির্যক ব্যঙ্গরস এবং সুগভীর অর্থব্যঞ্জনা।”
কবিতাগুলোকে কারো কাছে মনে হতে পারে প্রবচন, কারো কাছে স্বগোক্তি, কারো কাছে মনে হবে ভালবাসার মানুষের জন্য মনের সিন্দুক খুলে দিয়েছেন লেখক। যে যেভাবেই দেখুক শেষ পর্যন্ত কথাগুলো পাঠককে মুগ্ধ করে, ভাবিত করে বলেই দুর্দান্ত কবিতা হয়ে উঠে। কবিতাগুলোর কোন শিরোনাম নেই। শিরোনামের পরিবর্তে উপরে রয়েছে অলংকরণ আর তাই যেন কবিতাগুলোর নাম হয়ে উঠেছে। ৭ম পৃষ্ঠার দুই পংক্তির কবিতা-
“কেমনে কেমনে জানি
আমি তার হয়ে যাচ্ছি!”
কতো সাদামাটা ভাবেই না কতো গভীরে প্রবেশ করেছেন। যাকে ভালবাসতে হয়, নিজেকে তার মতোই করে নিতে হয়। ভালবাসার মানুষটির তাহলে ভালবাসতে সহজ হয়। তবে লেখক প্রথম কবিতায় বলেছেন-
“আমি অস্বাভাবিক মানুষ
আমার সংস্পর্শে কারো স্বাভাবিক থাকার কথা না।”
লেখকের ভালবাসা সরল নয়, গভীর। লেখক সুন্দরকে ভালবাসেন। সেই সুন্দর কি একজন নারী নাকি পছন্দের যে কোন নারী? একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“তার যে কোন সুন্দর দেখলেই
আমি নান রকম সমস্যাই পড়ে যাই।
ক্ষমা কর প্রভু!”
এমন অনেক কবিতায় মনে হবে হ্যাঁ একজনই। আবার মনে হবে সেই একজন ছড়িয়ে আছে বিশ্ব চরাচরে। তিনি লিখেছেন-
“নীলনদের জল আর জলকন্যা
আমাকে যখন তখন কাঁপায়।
যতদিন জীবন ততদিন কাঁপন।”
কবিতায় তিনি নিজের কথাও বলেছেন। সে কথাগুলোও পাঠককে ভাবাবে। তিনি লিখেছেন-
“এই জগৎ সংসার প্রতিনিয়ত
আমাকে তিল তিল করে শিখিয়েছে
কিভাবে অপ্রকাশিত থাকতে হয়
নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয়।”
এই কবিতায় লেখককে আমরা ভিন্নভাবে পেয়ে যাই। বাস্তবিকও লেখক আত্মপ্রকাশে ব্যকুল নন, নিজেকে গুটিয়েই রাখেন। এই আত্মানুসন্ধান সৃষ্টিশীল মানুষকে বিনির্মাণ করে বারবার। এর ভিতর দিয়েই কবি বারবারই ভালবাসার ও ব্যর্থতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার ভিতরে কাজ করতে থাকা বোধের প্রকাশ- তিনি খ্যাতির কাঙাল নন, ভালবাসার কাঙাল। দুই পংক্তির কবিতায় যদি ভালবাসার এমন কাঙালিপনার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে তবে অতো লেখার দরকারই বা কী? জীবনানন্দ দাশ বলতেন, উপমাই কবিতা। লেখক উপমাকেও প্রশ্রয় দেননি খুব একটা প্রকাশের জন্য। উপমার ভারে কবিতা ভারাক্রান্ত বা দুর্বোধ্য হওয়ারও সুযোগ রাখেননি। লেখকের ভালবাসাকে অনেক সময়ই মনে হয়েছে প্রগাঢ়। তিনি শতভাগ ভালবাসা দিতে ও পেতে চান। একটি কবিতায় লিখেছেন –
“তোমাকে দেখলে নীল জলের
মাছের কথা মনে হয়
সসেজ দিয়ে আলতো করে
খেতে মন চায়।”
এটা হল পরিপূর্ণভাবে পেতে চাওয়ার প্রকাশ। আরেকটি কবিতা এমন –
“আমি চাই সারাদিন সে পাখির মতো উড়ুক
দিন শেষে আমার কাছেই ফিরুক।”
একজন তরুণ প্রেমিকের আবেগ উছলে উঠেছে। কবিতাগুলো পড়লে মনে হবে- তিনি ভালবাসার কবিতা লিখেছেন আবার ভালবাসতে কবিতা লিখেছেন। সবসময় থাকতে চেয়েছেন ভালবাসার মানুষের পাশে। তার জন্য সবকিছু করতেই তিনি প্রস্তুত-
“মৃত্যুমুখে পড়লে ক্ষতি কী
বাঁচাবার জন্য আমি আছি তো।”
বইটির সবগুলোই প্রেমের কবিতা নয়। নিজের ভাবনা ও দর্শনও প্রকাশ করেছেন সেই ক্ষুদ্র অবয়বেই। একটি কবিতায় লিখেছেন-
“কারো ভাবনায় আমি ভাগ বসাতে
পারি না। এমনকি অংশগ্রহণও।”
এভাবে তিনি না-পারার বেদনার কথাও প্রকাশ করেছেন। প্রকৃতির কথাও বলেছেন। এমন দুটি পংক্তি-
“ভোরের সৌন্দর্য তুলনাহীন
সকল চরম সৌন্দর্যই কিঞ্চিত সময়ের জন্য।”
প্রথম পংক্তিই শেষ কথা নয়; মূল কথাটাই বলেছেন দ্বিতীয় পংক্তিতে- চরম সৌন্দর্য দীর্ঘ সময়ের জন্য কারো কাছে থাকে না। ব্যতিক্রমধর্মী কাব্যগ্রন্থটির সাফল্য কামনা করছি।
Discussion about this post