মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেক দিয়েছে, আবার কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানবাসীর কাছে ছিল একটি শোকবিধুর দিন। মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য শহীদদের সাথে যুক্ত হলো রাউজানের নিরীহ-নিরাপরাধ কিছু মানুষের নাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই স্বাধীনতাযুদ্ধের বলি হলেন তাঁরা। ফিরে দেখা যাক ৫২ বছর আগের ১৩ এপ্রিলের ঘটনাবলীর দিকে। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষ প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। রাউজান উপজেলা এর ব্যতিক্রম ছিল না। যুদ্ধের শুরুর দিকে শেখপাড়ার মরহুম আমজাদ আলীর পুত্র নৌবাহিনী কর্পোরাল আব্দুল করিমের নেতৃত্বে (যিনি পরে অনারারী ক্যাপ্টেন) ২০-২৫ জন কর্মী নিয়ে গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দল। অচিরেই এ খবর পৌঁছে যায় স্থানীয় শান্তি বাহিনীর কাছে। উল্লেখ্য যে, রাউজানের প্রত্যেকটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলো শান্তি বাহিনীর স্থানীয় প্রধান। ১১ এপ্রিল খবর আসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দক্ষিণ চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
১৩ এপ্রিল সকাল ৭ টায় পাকবাহিনীর ২০০ সদস্যের দুটি দল সর্তা ব্রীজ ও মদুনাঘাট সেতু পার হয়ে রাউজানে প্রবেশ করে। মদুনাঘাট পাওয়ার স্টেশন, রাউজান কলেজ ও ইমাম গাজ্জালী কলেজ- এই তিনটি কৌশলগত ঘাঁটিতে অবস্থান নেয় তারা। উত্তর রাউজান থেকে শুরু হয় বীভৎস গণহত্যা। এ গণহত্যায় ১৩টি স্থানে ১৬৯ জন নিরপরাধ মানুষ প্রাণ দেয়। এ গণহত্যার স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্যগহিরার শীলপাড়া (১০ থেকে ১২ জন), বড়পোল পালিতপাড়া (৮ জন), বণিকপাড়া (১১ জন), জগৎমল্লপাড়া (৩৬ জন), সুলতানপুর ছিটিয়াপাড়া (৯ জন), ঊনসত্তরপাড়া (৬৯ জন), বাড়ৈপাড়া (৪ জন), নোয়াপাড়া (১২ জন)। এছাড়াও ১০ ডিসেম্বর হলুদিয়ায় ১২ জন ও রাজাকারদের হাতে নিহত ৩ জনকে নিয়ে ১৮৪ জন নিরাপরাধ মানুষ শহীদ হন রাউজানে।
৩০ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হানাদার বাহিনীর কবলে আসে। ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীর ২৮ টি পরিবারের সদস্যরা কুন্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দিরের বিভিন্ন কক্ষে আশ্রয় নেয়। ৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁরা সেখানে অবস্থান করেন। সেখানে অবস্থানকারীদের মধ্যে ছিলেন ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক ফজলী হোসেন, ডঃ রশিদুল হক, ডঃ মাহমুদ শাহ কোরোশী প্রমুখ শিক্ষকবৃন্দ। দালালরা অপপ্রচার করে যে কুন্ডেশ্বরীতে ভারতীয় সৈন্য সমাবেশ শুরু হয়েছে এবং সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালিত হবে। শেষ পর্যন্ত খবর আসে কুন্ডেশ্বরী ভবন কারো জন্য নিরাপদ নয়। এ পর্যায়ে আশ্রিত শিক্ষকবৃন্দের পরিবার একে একে চলে যান এ ভবন ছেড়ে। বারবার অনুরোধ স্বত্ত্বেও অধ্যক্ষ নতুন চন্দ্র সিংহ এ ভবন ত্যাগ করেননি। তাঁর বক্তব্য ছিলো ‘আমিতো কারো ক্ষতি করিনি, জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি। এই শেষ বয়সে নিজের দেশ, মাটি আর আরাধ্য দেবী কুন্ডেশ্বরীকে ফেলে কোথাও যাব না, যদি মরতে হয় এখানেই মরবো। এখানে যদি মৃত্যুও হয়, তাহলে জানবো এই আমার নিয়তি, এই মায়ের ইচ্ছা।’ ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর গুজরা গ্রামের মামা বাড়িতে জন্ম নেন এ মহামানব। মাত্র আড়াই বছরে মা আর ৮ বছরে বাবাকে হারিয়ে কঠোর পরিশ্রম আর সাধনায় অসংখ্য সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে দশটার পরে নিহত হন কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের স্বত্বাধিকারী দানবীর নতুন চন্দ্র সিংহ। হানাদার বাহিনীর ঘাতকদল বিকাল ৪টায় প্রবেশ করে ঊনসত্তরপাড়া গ্রামে। চৈত্র সংক্রান্তির এ দিন ছিল মঙ্গলবার। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জড়ো করা হয় শতাধিক মানুষকে। হতভাগ্যরা বুঝতেও পারেননি কী হতে যাচ্ছে। সতীশ মহাজন বাড়ির পুকুরের পশ্চিম পাড়ে সারিবদ্ধভাবে গুলি করা হয় এ মানুষদের। নিহতদের মধ্যে যাঁদের পরিচয় পাওয়া গেছে তাঁদের নাম ঊনসত্তরপাড়া শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে উৎকীর্ণ আছে। শহীদদের মধ্যে দুজন মহাজন বাড়ির, দুজন ঘোষপাড়ার, দুজন মালিপাড়ার, ২০ জন পালপাড়ার, ১১ জন চৌধুরী পদবীধারী। এছাড়া রয়েছেন চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এ গ্রামে বেড়াতে আসা দক্ষিণ কাট্টলী, আগ্রাবাদ, বেতাগী, ফতেপুর গ্রামের হতভাগ্য আত্মীয়-স্বজন। মৃত্যুর এ মিছিলে নাম রয়েছে ডাক্তার নিরঞ্জন দত্তগুপ্তের। বিশ্বাসভঙ্গ আর নির্মমতার যাতনা সইতে না পেরে পরেরদিন ১৪ এপ্রিল বিষপানে আত্মহত্যা করেন ডাক্তার নিরঞ্জন দত্তগুপ্ত। ১৩ এপ্রিল আরো স্মরণীয় হয়ে আছে ইমাম গাজ্জালী কলেজের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখ সমরের জন্য। ১৩ এপ্রিল দোভাষি বাজার থেকে সকাল ৯ টায় পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দিকে যাত্রা শুরু করে মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এ দলে ছিলেন আশুতোষ কলেজের গণিতের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চৌধুরী, চাকসুর প্রথম জি. এস আব্দুর রব, প্রয়াত জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, বোয়ালখালী আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মোজাফফর আহমেদ, বাঁশখালীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুলতানুল কবির চৌধুরী (পরে এমপি), ফিরোজ আহমেদ, মোহাম্মদ ইদ্রিস, ড্রাইভার ইউনুস ও নজরুল ইসলাম। উদ্দেশ্য ছিল, ১৩ এপ্রিল সকালে দোভাষি বাজার থেকে পাহাড়তলী হয়ে রামগড় পৌঁছাবেন। কিন্তু সকাল ৯টায় পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে তাঁরা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সম্মুখীন হন। গাড়ির সামনে ছিলেন অধ্যাপক দীলিপ, মোজাফফর এবং ড্রাইভার ইউনুস। পেছনে ছিলেন সুলতান, ফিরোজ, সাইফুদ্দিন, নুরুল ইসলাম ও ইদ্রিস।
গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সাইফুদ্দিন খালেদ ও রব। বন্দী হন অধ্যাপক দিলীপ, মোজাফফর, ইউনুস, ফিরোজ। পরে তাদেরকে নির্মমভাবে অত্যাচারের পর মেরে ফেলা হয়। পালিয়ে বেঁচে যান সুলতান ও গুলিবিদ্ধ ইদ্রিস।
অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। এদিনে নিহত হওয়া সব শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজী বিভাগ, ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।
Discussion about this post