রেজি তথ্য

আজ: শুক্রবার, ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ১লা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

এয়ারলাইন্সের টিকিট জালিয়াতি, হজ্জ মৌসুম ছিল প্রধান টার্গেট

ঢাকা ব্যুরো:

ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সি খুলে বিমানের টিকিট বিক্রয় করে পরবর্তীতে যাত্রীকে না জানিয়ে টিকিট রিফান্ড করে অর্থ হাতিয়ে উধাও হয়ে যেতো একটি চক্র। পরে ওই যাত্রী বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারতো তার টিকিট বাতিল হয়েছে। তখন চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকতোনা। এয়ারলাইন্সের টিকিটের নামে অহরহ মানুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতানো এই চক্রের মূল টার্গেট ছিল সামনের হজ্জ মৌসুম। এ চক্রের মূলহোতা মাহবুবুর রশিদ নামে এক প্রতারককে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার।
ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গতকাল বুধবার রাজধানী গ্রীনরোড থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন এয়ালাইন্সের ৮১টি টিকেট উদ্ধার হয়, প্রতারণা কার্যে ব্যবহৃত ০২ টি মোবাইল ফোন, ২টি কম্পিউটার, ১টি প্রেস লেখা জীপ গাড়ী, ১২টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক, একটি ডাচ-বাংলা এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। ।
অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, গত ২৬ মার্চ
ভিকটিম জনৈক সাইদুর রহমানের সাথে প্রতারক মাহবুব রশিদের পরিচয় হলে সে এমকিউ ট্রেড এন্ড ট্রাভেল কনসালটেন্সি নামক প্রতিষ্ঠানের সিইও বলে দাবি করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিকিট ক্রয় করে যাত্রী বিদেশ পাঠায় বলে জানায়। তখন ভিকটিম তার পরিচিত পাঁচজনের মাস্কট, রিয়াদ এবং টরেন্টোর বিমানের টিকেট লাগবে বলে জানায়। পাঁচজনের টিকেট বাবদ সে প্রতারক মাহবুবকে ৫ লক্ষ ১০ হাজার টাকা প্রদান করলেও প্রথমত মাস্কট এবং রিয়াদের দুটি টিকিট প্রদান করে। কিন্তু রিয়াদের যাত্রী গত ২৮ মার্চ এয়ারপোর্টে এসে দেখেন তার টিকিট ইনভ্যালিড হয়ে গেছে। টিকেটিং এজেন্সি টাকা রিফান্ড করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলে জানতে পারে । আসামির সাথে যোগাযোগ করলে পরবর্তীতে আবার দুইটা টিকিট ইস্যু করে দিলেও ফ্লাইটে দিনে বাদী জানতে পারেন এই টিকিট দুইটিও রিফান্ডেড। পরবর্তীতে টরন্টোর টিকিট ইস্যু না করেই আসামি অফিস গুটিয়ে নিয়ে উধাও হয়। এরকম আরো কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে এবং অন্যান্য প্রতারণার সংবাদে ডিবি গুলশান তদন্ত শুরু করে।
প্রতারক মাহবুবুর রশিদ বিভিন্ন ফেইসবুক পেইজ এবং অ্যাকাউন্ট খুলে বিভিন্ন দেশে গমনাগমন, ওমরা পালন, সিঙ্গেল টিকেট ,আপ-ডাউন টিকিট, পরিবারের সদস্যদের বিমানের টিকিটের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। কোনো বিদেশ যাত্রীর টিকিটের প্রয়োজন হলে বা কোন কাস্টমার রাজি থাকলে তার কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে যাত্রীর পাসপোর্টের ছবি নেয়। পরবর্তীতে প্রতারক মাহবুবুর রশিদ দুবাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশী নাগরিক সাদের মাধ্যমে দুবাই হতে এবং পাকিস্তানের করাচির আল-গাফফার ট্রাভেলস, আনোয়ার সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড, জে এ এস ট্রাভেলস ; ভাওয়ালপুর এলাকার ফ্লাই-লিংক ট্রাভেলস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টিকেট সংগ্রহ করে মাহবুবকে হোয়াটসঅ্যাপে/মেইলে পাঠায়। কখনো কখনো বুকিং কনফার্ম করে এবং যাত্রীদের টিকিটের আইটেনারি প্রদান করে (যেখানে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নাম্বার যাত্রা বিবরণী ইত্যাদি থাকে) টাকা নিয়ে থাকে।
যাত্রীরা টাকা পরিশোধ করলে মাহবুব বিকাশের মাধ্যমে সাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা পৌঁছে দেয়। তখন সাদ দুবাই , পাকিস্তান হতে টিকিট ক্রয় করে দেয়। ফ্লাইট এর তারিখের পূর্বেই সাদ এবং মাহবুব পরিকল্পিতভাবে এয়ারলাইন্স এর কাছ থেকে সামান্য জরিমানা দিয়ে টিকেট রিফান্ড করে নেয়। ফ্লাইটের দিনে যাত্রীরা এয়ারপোর্টে গিয়ে টিকিট ইনভ্যালিড হয়ে যাওয়ার কথা শুনে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার দশা হয়। কারোর বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে চিকিৎসার জন্য -নিদিষ্ট সময়ে মেডিকেল এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে, কেউ স্টাডি এডমিশনের জন্য, ধর্মপ্রান মুসলিমরা যান পবিত্র ওমরা পালন করতে, কেউ তাহার নিয়মিত চাকরিতে যোগদান করতে যান। এই সকল যাত্রীরা শেষ মুহূর্তে বিমানের টিকিট ইনভ্যালিড শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান এবং চরম সংকটে পড়েন।
মাহবুব রশিদ এবং সাদ বিভিন্ন সময় ওমান এয়ার , এমিরেটস, গাল্ফ এয়ার ,সৌদি এ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস , সৌদিয়া, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ প্রভৃতি এয়ারলাইন্স -এর দুবাই, বাহরাইন, মাসকাট ,রিয়াদ, জেদ্দা, দোহা ,লন্ডন, টরেন্টো ,চট্টগ্রাম- মাসকাট, ঢাকা-দুবাই- দাম্মাম এর টিকিট বিক্রি করেছে।
ডিবি প্রধান বলেন, চক্রটির প্রধান মাহবুব উর রশিদের (৫১) সহযোগী জাহাঙ্গীর বিভিন্ন ক্লায়েন্ট সংগ্রহ, তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা ও বিভিন্ন ট্রাভেলিং এন্ড টুর এজেন্সীর সাথে সমন্বয়, প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতকৃত টাকা গ্রহণ ও বন্টনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে।
টিকিট বিক্রি করে প্রতারণাসহ নানা প্রতারণার ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা রাজধানীর ভাটারা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, কলাবাগান নিউমার্কেট থানায় ৬টি মামলা রুজু করা হয়েছে। পুরনো আরো ৩টি মামলা পাওয়া গেছে। বিস্তারিত তদন্ত অব্যাহত আছে বলে জানান এ কে এম হাফিজ আক্তার ।

অফিস পরিবর্তন: প্রতারক মাহবুবুর রশিদ ২০১৫ সালে কানাডায় লোক পাঠানোর কথা বলে মানুষকে জিম্মি করে টাকা পয়সা আদায় করার জন্য মোহাম্মদপুর থানা এবং ধানমন্ডি থানায় দুটি মানব পাচারের মামলার আসামি হয়। এ সময় তার প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল প্লানেট ওভারসিজ। এই লাইনে কাজ করতে করতে একসময় তার মাথায় বিমানের টিকিট প্রতারণার কৌশল মাথায় আসে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতারণাকাজের জন্য পর্যন্ত একাধিকবার অফিস পরিবর্তন করেছে। ২০১৫ সালে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায়, ২০১৮ সালে কাওরান বাজারে , ২০২১ সালে এলিফ্যান্ট রোডে এবং সর্বশেষ বসুন্ধরা এলাকায় তার সাময়িক অফিস স্থাপন করে।

মাহবুবুরের অন্যান্য প্রতারণা: আসামী দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/চাল ব্যবসায়ীদের তৈরিকৃত চালের নমুনা ও ঠিকানা সরবরাহ করে বলে বিভিন্ন টার্গেট ভিকটিমের কাছে দাবি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাল সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার গ্রহন করে। ব্যক্তি কোম্পানী/প্রতিষ্ঠানকে টনে টনে চাল দেওয়া কথা বলে অগ্রীম ৫০% টাকা নগদ অর্থ গ্রহন করে। এভাবে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি জনৈক ভিকটিম আবুল ফজলের কাছ থেকে চাল সরবরাহের কথা বলে ১৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ওয়ার্ক অর্ডার/চুক্তিভঙ্গের মাধ্যমে প্রতারণা: আসামী বিভিন্ন মানুষকে বলে সে সরকারি-বেসরকারি কনস্ট্রাকশন ও ড্রেজিংয়ের কাজ করে থাকে এবং সে বাঙ্গালী, করতোয়া নদীর ড্রেজিং এর ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছে তার কাছে ১২/১৪/১৬ ইঞ্চি ড্রেজার মেশিন আছে। বিভিন্ন কোম্পানী/প্রতিষ্ঠান ড্রেজার/কাজ নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলে ব্যক্তি , প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সাথে ১০০/৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিপত্র করে। কোম্পানী/প্রতিষ্ঠান থেকে কাজের কথা বলে অগ্রিম ১০/১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে কখনো কাজ না দিয়ে, কখনো ড্রেজার না দিয়ে উল্টো কোম্পানী/প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি প্রদান করে। এভাবে গত বছরের ১ এপ্রিল জনৈক জিয়া হাসিব সাগরের কাছ থেকে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়।

যে সর্তকতা অবলম্বন জরুরি:
ভুয়া এবং প্রতারক টিকেটিং/ ট্রাভেলিং এজেন্সীর হাত থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য যাত্রীদেরকে টিকিট ক্রয়ের ক্ষেত্রে সেই সকল টিকেটিং/ ট্রাভেলিং এজেন্সীর কাছ থেকে টিকিট ক্রয় করতে হবে যারা আইএ টিএ (অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিস অথবা এবিএটি ( অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রাভেল এজেন্সিস অফ বাংলাদেশ)। আইএটিএ ভুক্ত এজেন্সি গুলো এয়ারলাইন্স এর সাথে চুক্তি করার সময় তারা একটি বড় অংকের টাকা নিরাপত্তা জামানত হিসেবে দিয়ে রাখে, ফলশ্রুতিতে ঐসকল টিকেটিং /ট্রাভেল এজেন্সি পলাতক হতে পারে না বা মানুষের সাথে জালিয়াতি করতে পারে না। অতএব টিকিট করার ক্ষেত্রে আইএটিএ ভুক্ত বা এবিএটি ভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টিকিট ক্রয় করা জরুরি।
ভ্রমণের ন্যূনতম দুইদিন পূর্বে অথবা যুক্তিসঙ্গত সময় পূর্বে নিজের টিকিট কনফার্ম করা অর্থাৎ টিকেটটি ইনভ্যালিড হয়ে গেছে কিনা তা পরীক্ষা করা।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on pinterest
Pinterest
Share on reddit
Reddit

Discussion about this post

এই সম্পর্কীত আরও সংবাদ পড়ুন

আজকের সর্বশেষ

ফেসবুকে আমরা

সংবাদ আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১