Security is citizen rights, our duties and human rights
তাবিজ শব্দ দিয়ে আমি শুরু করতে চাই। আর এই তাবিজ আমাদের প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান সময়ে এখনো কমপক্ষে ২০℅ লোক লোহার খোসায় বানানো মাদুলি অথবা তাবিজের সাথেই সম্পৃক্ততার যোগসাজশ রয়েছে। তাবিজটাকেই রক্ষাকবচ বলে বিশ্বাস করতেন। তাবিজ গলায় অথবা শরীরের সাথে থাকলে নিজেকে নিরাপদ মনে করতেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় মানুষের মধ্যে সচেতনতা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং মানুষের নিরাপদ ও নিরাপত্তা বিষয়টি রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে পরিচালিত হওয়ায় একজন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত এবং নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারকেই রক্ষাকবচ হিসেবে গণ্য। আবার আমাদের করনীয় বিষয়ে পৌরনীতি ভাষায় বলতে হলে, সুশাসনের প্রধান নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ করে নিতে হবে। যদি সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সদস্য হিসেবে আমরা মনে করি তাহলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মৌলিক ও মানবাধিকার ভোগ করি, উভয় সমন্বয়ে দুটি পারস্পরিক ও পরিপুরক। নাগরিক অধিকার বিষয় শুধু বর্তমান সময়ের সাংবিধানিক অধিকার বললে তাও ভুল হবে। আমরা যদি ৫৭০ খ্রীস্টাব্দের পরবর্তী সময় ইসলাম ধর্মের নাজিলকৃত ধর্মগ্রন্থ কোরআন এর বাণী মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে জনগণকে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকের জানমাল ও ইজ্জত-আবরু তোমাদের পরস্পরের কাছে পূত-পবিত্র। তাই সমাজজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বজায় রাখা অবশ্যকর্তব্য ও ইমানি দায়িত্ব। তাহলে সেখান থেকে সাংবিধানিক অধিকার শব্দটি ব্যবহার যোগ্য হিসেবে স্বাধীন দেশের সাংবিধানিকভাবে যা বলা আছে, অন্য মানুষকে নিরাপদ রাখা ও বাঁচতে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম। কোনো ব্যক্তি, সংঘ, সংগঠন, বহিঃশত্রু বা স্বয়ং রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে উদ্যত হতে পারে না, বরং রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে।
এসব অধিকার ভোগের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ পায়। অন্যদিকে এসব অধিকার কর্তব্য পালনের ইঙ্গিত প্রদান করে। অর্থাৎ অধিকার ভোগের সাথে সাথে সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রতি কর্তব্য পালন করতে হয় অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ যে একটি ছাড়া অন্যটির কথা অকল্পনীয়।সআমরা যদি সর্বজনীন বিষয়টি নিয়ে কথা বলি তাহলে সামাজিক সম্প্রীতি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেতনা, অর্থনৈতিক দর্শন ও আদল-ইনসাফের মাধ্যমে অপরাধ দমন কৌশল ইসলামকে দিয়েছে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা। মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকের জীবনের মূল্য আইনের চোখে সমান। কোনো মুসলিম যদি অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে ফেলে, তাহলে একজন মুসলিম নাগরিককে হত্যার জন্য যেমন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, ঠিক অনুরূপভাবে এ ক্ষেত্রেও হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া শরিয়তের বিধান। যেহেতু মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা কোরো না।
সুতরাং কোনো মানবসন্তানকে অপহরণ, গুম, খুন ও নরহত্যা করা থেকে বিরত থাকা, নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তিপণ আদায়ের জন্য জোরপূর্বক ধরে নিয়ে খুন করা, মেরে ফেলা বা গুপ্তহত্যা করা আইনত অপরাধ ঠিক তেমনি ইসলাম কখনোই তা সম্মতি দেয়নি । একজন নিরপরাধ মানুষকে অস্ত্রের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রকাশ্যে বা গুপ্তহত্যা করা, অন্যায়ভাবে মানুষকে গুম করে নির্মমভাবে হত্যা করে নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিনষ্ট করা ইসলামে সুস্পষ্টভাবে কবিরা গুনাহ বলা হয়েছে তদরুপ সাংবিধানে ফৌজদারী কার্যবিধি অপরাধ হিসেবে গণ্য ৷ এর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ তাআলা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার পুরো মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল, আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর পুরো মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল। মনুষ্য সমাজে যেভাবে অপহরণ, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ফেতনা-ফাসাদ ও সন্ত্রাসবাদ চলছে, সর্বস্তরে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, এতে যেমন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম ব্যাঘাত হচ্ছে, তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে জননিরাপত্তার দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। যেসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন স্থানে নানা পর্যায়ে সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা ও প্রকাশ্য দিবালোকে নরহত্যা, অপহরণ, গুম, খুন-খারাবিসহ মানবাধিকার বিরোধী এবং মানবতাবিবর্জিত ধ্বংসাত্মক পৈশাচিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, বাস্তবে তারা মনুষ্যত্ব ও বিবেকহীনই বটে। এসব অপহরণ, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নীতি-নৈতিকতার সাথে প্রতিরোধ গড়ে তুলা নাগরিক কর্তব্য এবং প্রতিবাদের ভাষা কলম যোদ্ধা হিসেবে অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা, সমাজে ফেতনা-ফাসাদ, মানবিক বিপর্যয়, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করাকে হত্যার চেয়েও জঘন্যতম অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাই দেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে মানবাধিকার সুরক্ষায় ও নিরাপদ জীবনযাত্রার পরিবেশ সৃষ্টিতে সমাজে নরহত্যার মতো জঘন্য অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে ইসলামের ন্যায়বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের বিকল্প নেই। ঠিক তেমনি
নাগরিক অধিকার ছাড়া কোনো মানুষ নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারে না। যে সমাজে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়, সে সমাজে আইনের শাসন নেই। মানুষের জানমালের নিরাপত্তাই যদি বিঘ্নিত হয়, তবে মানুষ সমাজে কীভাবে শান্তিতে বসবাস করবে? কোনো অপশক্তির কাছেই যেন জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় আর মানবতা বিব্রত না হয়! প্রতিপক্ষের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের অনিবার্য পরিণতিতে অপহরণ, গুম, খুন, নির্মম হত্যাকাণ্ড, অমানবিকতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় ঘৃণা ব্যক্ত করা যায়, জোরালো প্রতিবাদ জানানো যায়, জনগণের জানমাল রক্ষায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় এবং সংগ্রামী সচেতন মানুষের সেটাই করণীয়। জননিরাপত্তায় ব্যর্থ হলে শান্তিপ্রিয় যেকোনো মানুষের ওপরই জিঘাংসার হিংস্র কালো থাবা নেমে আসতে পারে।
নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি আমাদের কর্তব্যের ধারনা, পারস্পরিক সম্পর্ক, শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। এদিকে পৌরনীতি ও সুশাসনের ভাষায় আন্তর্জাতিক সাংবিধানিকভাবে মানবাধিকার বিষয় যা বুঝাতে চাইছে তা নিম্নে হুবহু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি
সাধারণত অধিকার বলতে নিজের ইচ্ছানুযায়ী কোন কিছু করার বা পাওয়ার ক্ষমতাকে বোঝায়। এদিক থেকে
বিচার করলে আইন বিরোধী কাজ করাকেও অধিকার বলা যায়। কিন্তু পৌরনীতি ও সুশাসনে এ ধরনের কাজকে
স্বেচ্ছাচার বলা হয়। অধ্যাপক আনেস্ট বার্কার যথার্থই বলেন, অধিকার তখনই প্রকৃত অধিকার হতে পারে যখন রাষ্ট্র সেগুলোকে অধিকার বলে স্বীকার করে এবং সেগুলো রক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত সুযোগ বা সুবিধাকে অধিকার বলা যায়। যেমন পরিবার গঠন, শিক্ষা লাভ, নির্বাচনে ভোটদান, নির্বাচিত হওয়ার মত অধিকারের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও অনুমোদন রয়েছে।
অধিকার ভোগের ও কর্তব্যের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো, সেই সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রে কল্যাণকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি বলেন ‘অধিকার বলতে আমরা সামাজিক জীবনের সেসব শর্তকে বুঝি, যা ব্যতীত।
যেমন :-
১। নৈতিক অধিকার: যেসব অধিকার নাগরিকের বিবেক বা ন্যায়বোধ থেকে সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে নৈতিক অধিকার বলা হয়। যেমন, সন্তানের কাছে মা-বাবার শ্রদ্ধা প্রাপ্তির অধিকার কিংবা প্রতিবেশীর কাছ থেকে সদাচারণ পাবার অধিকার। এসব অধিকার নাগরিকের বিবেক ও ন্যায়বোধ থেকে উদ্ভব হয়। নৈতিক অধিকার ভঙ্গের জন্য রাষ্ট্র শাস্তি দেয় না, তবে এই অধিকার খর্বকারীকে সমাজ স্বাভাবিকভাবে নেয় না।
২। আইনগত অধিকার: যেসব অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত, সেগুলোকে আইনগত অধিকার বলে। যেমন জীবন ধারণের অধিকার, ভোটদানের অধিকার, শিক্ষার অধিকার। এসব অধিকার ভঙ্গ করলে বা হরণ করলে রাষ্ট্র শাস্তি প্রদান করে। আইনগত অধিকারকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা
(ক) সামাজিক অধিকার : সমাজে সুন্দরভাবে সুখ-শান্তিতে বসবাসের জন্য নাগরিকগণ যেসব অধিকার ভোগ করে, সেগুলোকে সামাজিক অধিকার ভোগ বলে। যেমন জীবন রক্ষা, মত প্রকাশ, চলাফেরা, বিনা বিচারে আটক না হওয়া, সংঘবদ্ধ হওয়া, সভা-সমিতি, চুক্তি স্থাপন, সম্পত্তি ভোগ, আইনের চোখে সমতা লাভ, শিক্ষা লাভ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, পরিবার গঠন, নিজ-নিজ সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চার অধিকার। সভ্য জীবন-যাপনের জন্য এসব অধিকার নাগরিকের জন্য অপরিহার্য।
(খ) রাজনৈতিক অধিকার: রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের জন্য নাগরিকরা যেসব অধিকার ভোগ করে, সেগুলোকে
রাজনৈতিক অধিকার বলে। যেমন ভোটদান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সরকারি চাকরি লাভ, সরকারি কাজের সমালোচনা, আবেদন করা রাজনৈতিক অধিকার। এসব অধিকারের মাধ্যমে আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহন করতে পারি।
(গ) অর্থনৈতিক অধিকার: ক্ষুধা, দারিদ্র ও বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নাগরিকগণ যেসব অধিকার ভোগ
করেন, সেগুলোকে অর্থনৈতিক অধিকার বলে। যেমন কর্মের অধিকার, উপযুক্ত পারিশ্রমিক, অবকাশ যাপন প্রভৃতি অর্থনৈতিক অধিকার। নাগরিকগণ এসব অধিকার ভোগ করার সুযোগ পেলে ক্ষুধা, দারিদ্র ও বেকারত্ব দূর হবে এবং অন্যান্য অধিকার ভোগের চাহিদা সৃষ্টি হবে। এজন্য বলা হয় অর্থনৈতিক অধিকার ব্যতীত রাজনৈতিক অধিকার অর্থহীন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অধিকার পূরণ হলেই রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার ভোগের আকাঙ্খা তৈরি হয়।
১. আইনের দৃষ্টিতে সমতা: সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী।
২. সমানাধিকার: ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমানাধিকার লাভ করবে। নারী, শিশু ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য রাষ্ট্র বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারবে।
লেখক – সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
Discussion about this post