আদালত অবমাননার নোটিশ দেয়া সত্ত্বেও কর্ণফুলী নদী দখল করে গড়ে উঠা ২১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নিরব চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের খবরদারিত্ব এবং অসহযোগিতার কারনে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছেনা বলে জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি কর্ণফুলী দখল করে গড়ে উঠা সোনালী যান্ত্রিক মাছ বাজার কর্তৃক দায়েরকৃত (৭২০/২১) রিট মামলাটি হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ফারাহ মাহাবুব এবং বিচারপতি আহমেদ সোহেল খারিজ করে দেন। এর ফলে ২০১০ সালে দায়েরকৃত (মামলা নং ৬৩০৬/১০) মামলার আদেশ অনুযায়ী জেলা প্রশাসন চিহ্নিত এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইডে প্রকাশিত ২১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে উদ্যোগ গ্রহন করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদ কামাল কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্টিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে পত্র প্রদান করেন। উক্ত পত্রের আলোকে গত ৬ মার্চ চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী সংশ্লষ্ট বিভাগকে অবৈধ স্থাপনা সমূহে সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ প্রদান করেন।
এর আগের দিন ৫ মার্চ ২০২৩ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জেলা নদী রক্ষা কমিটির এক সভা জেলা প্রশাসকের সভা কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক মো: আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের সভাপতিত্বে উক্ত সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী এবং জেলা প্রশাসকের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। সভায় বন্দরের প্রতিনিধি কর্ণফুলী দখল করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করতে বিভিন্নভাবে জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ও জেলা প্রশাসককে চাপ প্রয়োগ করে বক্তব্য প্রদান করেন। পরে জেলা প্রশাসক মাগরিবের আজান হচ্ছে বলে সভার সমাপ্ত করেন।
উক্ত সভার পর থেকে কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম রহস্যজনক কারণে স্থবির হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত ১২ মার্চ কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে রিট মামলা দায়েরকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জেলা প্রশাসনকে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়ন না করায় আদালত অবমাননার (কনটেম্পট কোর্ট) অভিযোগে ১৫ দিনের সময় দিয়ে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করেন। আজ ২৭ মার্চ উক্ত লিগ্যাল নোটিশের সময়সীমা অতিবাহিত হচ্ছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন থেকে কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোন প্রকার পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এই প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হবে। কর্ণফুলী দখল করে অনেক বড় অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এইসব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসলে আমাদের কাজ সহজ হবে।
এর আগে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর এলাকায় অবস্থিত অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ না করায় এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে ব্যক্তিগতভাবে আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ দেন এবং তার আচরণ ব্যাখ্যা করতে বলেন। হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের প্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান, আদালতে হাজির হয়ে রায় মেনে চলার পাশাপাশি নদীর জমি থেকে অবৈধ দখলদারের নির্মাণ উচ্ছেদ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। পরবতর্ীতে লালদিয়ার চলে তিন শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
হাইকোর্টে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদীর বিএস ১নং খাস খতিয়ানের ৮৬৫১ দাগের কর্ণফুলী নদী শ্রেনীর ভূমি দখল করে গড়ে মাছ বাজার ও ভেড়া মার্কেটের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করছে না চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিপরিতে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ নোটিশ প্রদানের পর উক্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করতে বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আমরা ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করার অভিযোগে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছি। দুই একদিনের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানকেও একই নোটিশ প্রদান করা হবে। লিগ্যাল নোটিশে দেয়া সময়ের মধ্যে ২১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে মহামান্য হাইকোর্টকে অবহিত না করলে আদালত অমমাননার অভিযোগে হাইকোর্টে কনটেম্পন্ট মামলা দায়ের করা করা হবে।
প্রসঙ্গত কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ২০১০ সালে হাইকোর্টের রিট মামলা দায়ের করেন হিউম্যান রাইট এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের সংগঠনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। ২০১৬ সালে উক্ত মামলার রায় প্রদান করে হাইকোর্ট। রায়ের আদেশ জেলা প্রশাসন চিহ্নিত ২১৮৭ টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসনেক নির্দেশ দেয়া হয়। উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশিদ ২০১৮ সালে উক্ত আপিল খারিজ হয়ে গেলে ২০১৯ সালের ৪-৯ ফেব্রুয়ারি পাঁচদিন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান করে তিন শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ করে ১০ একর নদীর জমি উদ্ধারের পর রহস্যজনক কারণ উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।
Discussion about this post