হিজরী নববর্ষ মানেই আরবি ক্যালেন্ডারে যুক্ত হলো আরও একটি নতুন বছর ১৪৪৫ হিজরী। হিজরী নববর্ষ তথা আরবী নতুন বছর, নতুন মাস, নতুন সপ্তাহ এবং প্রতিটি নতুন দিন ও রাত আমাদের জীবনের অংশ, মহান রাব্বুল আলামিনের মহা নিয়ামত।
আরবী নববর্ষ তথা হিজরী নববর্ষকে নতুন সংকল্পে আমাদের বরণ করা উচিত। কোরআন মাজীদে এ সম্পর্কে এরশাদ করা হয়েছে –
وهو الذي جعل الليل والنهار خلفة لمن اراد ان يذكر او اراد شكورا
এবং তিনিই সেই সত্বা, যিনি রাত ও দিন কে পরস্পরের অনুগামী করেছেন। (কিন্তু এসব বিষয় উপকারে আসে কেবল) সেই ব্যক্তির জন্য যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়। (সূরা ফূরক্বান – আয়াত ৬২)।
সুতরাং সৌভাগ্যবান তো সেই ব্যক্তি, যে হিজরী নববর্ষে নতুন সংকল্পে ও নতুন সূচনায় নিজেকে এমন কাজে নিয়োজিত করে যার মাধ্যমে আখেরাতের মুক্তি পাওয়া যায়। দুর্ভাগা সেই ব্যক্তি যে নতুন সময় ও সূচনায় এমন কাজে লিপ্ত থাকে যা তার ধ্বংসের কারন হয়ে দাড়ায়।
মহররম মাসের ফজিলত ও গুরুত্ব:
********************************
হিজরী নববর্ষের তথা আরবী নববর্ষের মহররম হল আরবি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস। মহররম শব্দটি আরবি – যার অর্থ নিষিদ্ধ, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে মহররম মাস পবিত্র হিসাবে গণ্য এবং জাহিলি যুগের আরবরাও হারাম মাস বলে করতো। আরবি ক্যালেন্ডারে যে কয়টি দিন বিশেষ মর্যাদাপূণর্, তার মাধ্যে ১০ মহররম বা আশুরা দিন অন্যতম। পবিত্র কোরআনুলকারীমে মহান রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেছেন –
اان عدة الشهور عنده الله اثنا عشر شهرا في كتاب الله يوم خلق السماوات والارض منها اربعة حرم
নিশ্চয় আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহ নিকট মাসের গণনায় মাস বারটি। তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। (সূরা তাওবা – আয়াত ৩৬)
সহীহ্ হাদীস শরীফে মহররম মাসের বহু ফজিলতের কথা বর্ননা করা হয়েছে। এ মাসে অধিক পরিমাণে নফল রোজা ও তওবা ইস্তেগফার এর প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে –
عن ابي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم افضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم وافضل الصلاة بعد الفريضة صلاة الليل
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরাইরা (রা:) এ সম্পর্কে বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ফরজ নামাজের পর শ্রেষ্ঠ নামাজ হলো শেষ রাতের (নফল) নামাজ আর রমজানের পর সেরা রোজা হলো মহররম মাসের রোজা। (সহীহ মুসলিম – ১১৬৩)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) নবীজী (সাঃ) এর আমলের কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে আমি দেখিনি আশুরার দিনের রোজা আর রমজান মাসের রোজা ছাড়া অন্য কোন দিনে রোজা কে এত গুরুত্বের সঙ্গে খুঁজছেন। (সহীহ বুখারী – ২০০৬)
মহররম মাসের পবিত্র আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তা বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করিয়ে দিবে (সহীহ মুসলিম – ১১৬২)।
আশুরা দিবসের ঘটনাবলী:
************************
বিশ্বের বিভিন্ন জাতির ইতিহাস কিভাবে এ দিনের সঙ্গে জড়িত তার প্রতি দৃষ্টি দিলে সহজেই আমরা আশুরার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদমকে (আ.) প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি, জান্নাতে অবস্থান, পৃথিবীতে প্রেরণ ও তওবা কবুল সবই আশুরার তারিখে সংঘটিত হয়।
হজরত নূহ (আ.) সাড়ে ৯শ’ বছর তাওহিদের দাওয়াত দেওয়ার পরও যখন পথভ্রষ্ট জাতি আল্লাহর বিধান মানতে অস্বীকৃতি জানায়; তখন তাদের প্রতি নেমে আসে আল্লাহর গজব মহাপ্লাবন। এই মহাপ্লাবনের ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা পায় তারা যারা আল্লাহ ও নবীর প্রতি বিশ্বাসী হয়ে হজরত নূহের (আ.) নৌকায় আরোহণ করে।
ওই নৌকা ৪০ দিন পর জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মাটি স্পর্শ করে ঐতিহাসিক আশুরার দিন।
এ দিনেই হজরত ইবরাহিমের (আ.) জন্ম, ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত ও নমরুদের অগ্নি থেকে রক্ষা পান। হজরত ইদরিসকে (আ.) বিশেষ মর্যাদায় চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয় আশুরার দিনে। সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর হজরত ইউসুফের (আ.) সঙ্গে তার পিতা হজরত ইয়াকুবের (আ.) সাক্ষাৎ যেদিন হয়- সে দিনটি ছিল আশুরার দিন।
নবী আইয়ুব (আ.) দীর্ঘ ১৮ বছর কুষ্ঠরোগ ভোগ করার পর আরোগ্য লাভ করেছিলেন আশুরার দিন। হজরত ইউনূস (আ.) ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পর মুক্তিলাভ করেন আশুরার দিন। ঘটনাক্রমে হজরত সোলায়মান (আ.) সাময়িক রাজত্বহারা হন। আল্লাহতায়ালা তাকে আবারও রাজত্ব ফিরিয়ে দেন আশুরার দিনে।
আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা (আ.) ও তার অনুসারী বনি ইসরাইলদের ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে পানির মধ্যে রাস্তা তৈরি করে দিয়ে পার করে দেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ সাগরে ডুবিয়ে মারেন আশুরার দিন। হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছিলেন আশুরার দিনে। এ দিনে হজরত ঈসার (আ.) জন্ম হয় এবং ইহুদিরা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে আল্লাহতায়ালা তাকে ফেরেশতা কর্তৃক সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন এ দিনেই। দাবী করা হয়, কাবা শরিফ সর্বপ্রথম গিলাফ দ্বারা আবৃত করা হয়েছিল আশুরার দিন।
এ পৃথিবীর অস্তিত্বের সঙ্গেও আশুরার দিনের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। আশুরার দিনেই আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন আকাশমালা, মর্তজগৎ, পর্বতরাজি, লওহ-কলম ও ফেরেশতাদের। আশুরার দিনে আল্লাহ নিজ আরশে আজিমে অধিষ্ঠিত হন। এভাবে পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ দিনের সম্পর্ক।
পবিত্র আশুরা দিবসের শিক্ষা:-
***************************
আশুরার দিনটি যে কারণে বিশ্ব মুসলিমের কাছে অত্যন্ত স্মরণীয়, শিক্ষণীয় ও হৃদয়বিদারক তা হলো- কারবালার ঘটনা। হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে সত্যের জন্য সংগ্রাম করে কারবালার প্রান্তরে সপরিবারে শাহাদত বরণ করে সর্বোচ্চ ত্যাগের অতুলনীয় আদর্শ রেখে গেছেন। আশুরার এসব ঘটনাবলীতের রয়েছে মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু। আশুরার মহান শিক্ষাগুলো হলো-
১. আশুরার দিনটি মূলত বাতিলের পরাজয় এবং সত্যপন্থী, হকপন্থীদের বিজয় ও মুক্তির দিবস।
২. নবী ও তাদের অনুসারীগণের ইতিহাস স্মরণপূর্বক আল্লাহর বিধান পালন ও বাস্তবায়নে অবিচলতা, দৃঢ়তা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা যথার্থমানের হতে হবে। তাহলেই কেবল আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর সব বাতিল শক্তির মোকাবেলায় মুসলমানদের বিজয়ী করবেন।
৩. ঈমান-আকিদাবিরোধী সব কার্যকলাপ বন্ধ করতে সচেষ্ট হতে হবে।
৪. ইসলাম সম্পর্কে যারা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে তাদেরকে সঠিক ধারণা প্রদান করতে হবে এবং ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে সবাইকে আহ্বান জানাতে হবে।
৫. সত্য ও ন্যায়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বাতিলের মোকাবেলায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে।
৬. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব কাজে ত্যাগ এবং কোরবানির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
৭. সুযোগ থাকার পরও যেমন হজরত হোসাইনের (রা.) সাথীরা তাকে ছেড়ে না গিয়ে তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সঙ্গে থেকেছেন; তেমনি আমাদেরও উচিত সর্বদা সত্যপন্থীদের সমর্থন, সহযোগিতা ও সঙ্গে থাকা।
৮. ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সার্বিক সফলতা অর্জনের জন্য নিজেরা ভালো আমল করা, সর্বপর্যায়ে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন এবং খোদাভীরু নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো।
*মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে পবিত্র আশুরা দিবসের ঘটনাবলী থেকে নিয়ে ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে সত্যপ্রতিষ্ঠার পক্ষে ও মিথ্যার বিরুদ্ধে ইসলামের আলোকে জীবনযাপন করতে পারি
আল্লাহ তায়ালা আমাদের তওফিক দান করুন। (আমিন)।
লেখক: – সাংবাদিক ও কলামিস্ট:
Discussion about this post