ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়নের তুরাগ নদীর পাড়ে বাগিচারটেক গ্রামে প্রায় পঞ্চাশের বেশি জেলে পরিবারের বসবাস। জুন থেকে সেপ্টেম্বর, বছরের এই চার মাস জেলেরা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও বাকি আট মাস নদীর পানি দূষণের কারণে জেলেদের বাধ্যতামূলকভাবে বেকার থাকতে হয়। তুরাগের পানি দূষণের কারণে মাছ না থাকায় জেলেদের অনেকে তাদের পূর্বপুরুষের জেলে পেশা থেকে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হয়, আবার তাদের অনেকেই এই সময়টাই বেকার জীবন কাটাতে হয়। বেকার সময়টাই জেলে পরিবারগুলোকে অধিক হারে সুদে ঋণ নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। নদীর পানি দূষণের কারনে এই আট মাস জেলে পরিবারগুলোকে পানি, স্বাস্থ্য, ও বেকার সমস্যা কাধে নিয়ে জীবন চালাতে হয়, তার সাথে চলে ঋণের কিস্তির চাপ নিয়ে বেঁচে থাকার এক কঠিন লড়াই। ঢাকার খুব নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করা এই জেলে সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ নদী দখল-দূষণ কারণে জীবিকা হারিয়ে এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। বাগিচারটেক গ্রামের জেলে পরিবারগুলোর নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহের জন্য পানির পাম্প স্থাপনের মাধ্যমে জেলেদের জীবন সংগ্রামের সাথে সংহতি জানিয়েছে ‘রিভার এন্ড ডেল্ট রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। নদী দূষণের কারণে জেলেদের জীবিকা পরিবর্তন, জীবন ধারনজনিত সমস্যা নিয়ে আলোচনার ও পানির পাম্পের আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধনের মধ্যমে দিনটি উজ্জাপিত হয়।রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)-এর চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ-এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন নেক্সাস টিভির কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের প্রধান আমিন আল রশিদ, নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক ক্লাইমেট এক্সপার্ট মনির হোসেন চৌধুরী, নোঙ্গর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস, নদী অধিকার মঞ্চের সদস্য সচিব শমশের আলী, উন্নয়ন গবেষক আমিনুর রসুল, বেলা’র নদীবিষয়ক প্রকল্পের কর্মকর্তা মো. মুজাফ্ফুর ফয়সাল এবং ইকো ঢাকার রোটারি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মো. সাইফুল ইসলাম সহ আরো অনেকে। নেক্সাস টিভির কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের প্রধান আমিন আল রশিদ তার বক্তব্যে বলেন- নদীর সাথে নদীর পাড়ে বসবাসকারী জনপদ দূষণের কারণে সংকটে থাকে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বিপন্ন প্রাণীর নাম নদী। নদী একটি জীবন্ত সত্ত্বা। কিন্তু সেই নদীকে আমরা দখল-দূষণের মাধ্যমে মেরে ফেলছি, সাথে নদী পাড়ের জনপদগুলোকেও। নদী ও নদীর পাড়ের মানুষদের বাঁচাতে এগিয়ে আসার জন্য আরডিআরসিকে ধন্যবাদ। নদী রক্ষা কমিশনের ক্লাইমেট এক্সপার্ট মনির হোসেন চৌধুরী বলেন- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তুরাগ নদীতে বর্ষার শুরুতে পানি প্রবাহ কমে গেছে যার কারণে নদীতে মাছের উৎপাদন কমে গেছে, যা নেই বললেই চলে। এছাড়া নদী পানিকে দূষিত করে আমরা নদীকে মেরে ফেলছি। নদীতে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবাইকে একাত্ত্ব হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।নোঙ্গর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস বলেন- মৌলিক অধিকার যেমন, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে এই জনপদের লোকজন বঞ্চিত। দেশের উন্নয়নের মাঝে এই সম্প্রদায় গণনার বাহিরে। নদীর পাড়ের জনপদের উন্নয়নের মাধ্যমে নদীর সার্বিক উন্নয়ন হয়। এই জনপদের সংকটের কথা ভেবে নিরাপদ খাবার পানি চাহিদা পূরণের জন্য পানির পাম্প সহায়তা করায় আরডিআরসিকে ধন্যবাদ।নদী অধিকার মঞ্চের সদস্য সচিব শমশের আলী বলেন- নদী দূষণের কারণে এই অঞ্চলের জেলেরা বেকার সময়ে সরকারি যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা হয়েও এই এলাকার জেলেরা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নদী দূষণের কারণে এই অঞ্চলের মানুষ জীবিকার সমস্যা, খাদ্যের সমস্যা, নিরাপদ পানির সমস্যার সরাসরি ভুক্তভোগী হলেও পরোক্ষভাবে এটি জাতীয় সমস্যা। নদী ও নদীর পাড়ের জনপদকে বাঁচাতে দেশের শিক্ষিত সমাজকে সচেতন হতে হবে।উন্নয়ন গবেষক আমিনুর রসুল বলেন- দেশের জনগণ ভালো থাকা মানে দেশ ভালো থাকা। দেশের মানুষকে ভালো রাখার দায়িত্ব সরকারের। একটি স্থানের সংকট সমাধান ও মানুষকে ভালো রাখার মাধ্যম হচ্ছে সেখানকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। এর সাথে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে যে কোনো সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।ইকো ঢাকার রোটারি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মো. সাইফুল ইসলাম বলেন- নদী রক্ষা করতে হলে পানি, মাটি, নদীর পরিবেশ, নদী নির্ভর জনগোষ্ঠী সবকিছুই রক্ষা করতে হবে। তার জন্য সবাইকে সঙ্গবদ্ধ থাকতে হবে। এই অঞ্চলের মানুষের সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে আমরা আরডিআরসি’র সাথে কাজ করে যাবো।সভায় বাগিচারটেকের জেলে সম্প্রদায়ের প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকে জীবিকা ও অন্যান্য সমস্যার বিষয় তুলো ধরেন। তারা জানান, তাদের পূর্বপুরুষদের পেশা ছিল জেলে পেশা। এই পেশার উপর তাদের পরিবার জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু পানি দূষণের কারণে নদীতে মাছ না থাকায় তাদের বছরের প্রায় আট মাস বেকার থাকতে হয়। অনেকে নদী দূষণের কারণে পূর্বপুরুষের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হয়। আবার অনেকে এই আট মাস শ্রমিকের কাজ করে, ভ্যান চালায়, নৌকা চালায়। অনেকে এই সময়টাতে ঋণ নিয়ে চলতে হয়। তারা আরো জানায়, নদী দূষণের কারণে তাদের নিরাপদ খাবার পানির সংকট। এই অঞ্চলে পর্যাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থা নেই। নদীর দূষিত পানির কারণে শুকনো মৌসুমে তারা চর্মরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু তাদের এই অঞ্চলে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় তারা পর্যাপ্ত চিকিৎসা পায় না। রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ জানান-ঢাকার আশেপাশের জেলেরা সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো জেলেদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। নদীর পাড়ের বিলগুলো যত ভরাট হচ্ছে, জেলেদের বেঁচে থাকার সুযোগ ততোই কমে যাচ্ছে কারণ বিল না থাকলে মাছ বাঁচবে না আর মাছ না বাঁচলে জেলেদের জীবিকা থাকবে না। সুতরাং নদীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি নদী পাড়ের জলাভূমিগুলোও রক্ষা করা জরুরি।তিনি আরো জানান- এই অঞ্চলের জেলেদের সরকারি তথ্যে অন্তর্ভুক্তির জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এই অঞ্চলের জেলেদের চিকিৎকসা সেবার জন্য মেডিক্যাল ক্যাম্প করে ফ্রি চিকিৎসা সেবা ও ঔষুধের নিশ্চয়তার আশ্বাস দেন।
Discussion about this post