‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে/সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে’- জসীমউদ্দিনের কবিতার মতোই প্রকৃতিতে শীতের আমেজ বেশ স্পষ্ট। সন্ধ্যা-সকাল কুয়াশার চাদর মুড়ে দিচ্ছে চারপাশ। মন ছুঁয়ে যাওয়া শীতের শুভ্রতায় ফুরফুরে মনটা একেবারেই ঘোরার মেজাজে। সময়টা ২০২৩ এর ৩১ ডিসেম্বর। কাট্টলীর নিরিবিলি পর্যটন কেন্দ্রে চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স ফোরামের বার্ষিক বনভোজন ও মিলনমেলার আয়োজন ছিল বছরের শেষ দিনটাতেই।
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল প্রায় ১০টা। সকালের সূর্যের স্নিগ্ধ আলোতে সাগরতীর কাট্টলীর ঘাস আর পাতা যেন ঝলমল করে উঠেছে। রাসমনি ঘাটের কাছাকাছি নিরিবিলি পর্যটন কেন্দ্রও দর্শনার্থীদের বরণ করার অপেক্ষায়! নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার ‘নিরিবিলি’ নামের এ পর্যটন কেন্দ্র আসলেই যেন নিরিবিলি। আয়োজক কমিটির অনেকে এলেও বেশিরভাগ সংবাদকর্মী তখনো পৌঁছাননি। তবে সময় একটু গড়াতেই নির্ধারিত স্পটে একে একে থামছিল মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস। মূল গেইটে প্রবেশ করতেই আগত সাংবাদিক ও অতিথিদের রজনী গন্ধা ফুল আর নাস্তার প্যাকেট দিয়ে স্বাগত জানান বনভোজন ও মিলনমেলার অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যরা। এদিন নিজ পেশার বন্ধুদের সঙ্গে আবেগ-উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসা বিনিময় করতে ছুটে আসেন প্রায় ৮০ জন সংবাদকর্মী। দ্বিতীয় তলায় অডিটরিয়ামে শিল্পীদের কন্ঠে চলছিল জনপ্রিয় সব গান। আর নিচে খোলা প্রাঙ্গনে আনন্দ-আড্ডায় মেতে ওঠেছিলেন সংবাদকর্মীরা। এদিন কর্মজীবনে ব্যস্ত সময় কাটানো পরিচিত বন্ধু-সহকর্মীদের কাছে পেয়ে কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়েন কুশল বিনিময়ে, কেউ বা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেন মুগ্ধ আলিঙ্গনে। কেউ খুলেছেন গল্পের ঝাঁপি। নিজের পেশার প্রসঙ্গও উঠে এসেছে কমবেশি। তবে ছবি তোলাতেই ব্যস্ত ছিলেন বেশিরভাগ। নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগে দলবেঁধে বেরিয়েও পড়েন অনেকে। প্রাণে প্রাণ মিলেমিশে থাকার বন্ধুত্বের এমন আবেগ আর উচ্ছ্বাস বুঝিয়ে দিল বাঁধন আলগা হয়নি মোটেও। এভাবে ম্যারাথন আড্ডা আর ছবি তোলায় কেটে যায় প্রায় দু’ঘণ্টা।
বেলা ১২টার দিকে ফোরামের নির্বাহী সদস্য ও বনভোজন কমটির সদস্য সচিব কামাল পারভেজ-এর সঞ্চালনায় শুরু হওয়া সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন ফোরাম সভাপতি কাজী আবুল মনসুর, সহ সভাপতি আলমগীর অপু, সাধারণ সম্পাদক আলিউর রাহমান, সহ-সম্পাদক গোলাম মাওলা মুরাদ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মনিরুল পারভেজ, ক্রীড়া সম্পাদক সাইফুল্লাহ চৌধুরী, সমাজসেবা সম্পাদক ও বনভোজন কমিটির আহবায়ক লোকমান চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ আইয়ুব আলী, নির্বাহী সদস্য আলী আহমেদ শাহীন, সিনিয়র সাংবাদিক জুবায়ের সিদ্দিকী, বনভোজন রেজিস্ট্রেশন কমিটির আহবায়ক নূর মোহাম্মদ রানা, অভ্যর্থনা কমিটির আহবায়ক নূর উদ্দিন সাগর, সদস্য রাজিব চক্রবর্তী ও মুকুল মাহি। এসময় ‘টিআইবি পুরস্কার’ অর্জনের জন্য একুশে পত্রিকার সাংবাদিক, ফোরাম সদস্য শরীফুল ইসলাম রুকনকে অভিনন্দন ও সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ফোরাম সভাপতি কাজী আবুল মনসুর তাঁর বক্তৃতায় বলেন, অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স ফোরাম এ পর্যায়ে এসেছে। শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স ফোরামের কলেবর বাড়ছে।
তিনি বলেন, এখন ডিজিটাল প্লাটফর্মের যুগ। সাংবাদিকতা এখন আর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বরং অনেক বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে গেছে। বর্তমানে বিশ্বে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা বাড়ছে। বিশ্বে সাংবাদিকতার উপর বড় বড় অনেক পুরস্কার পান ফ্রীল্যান্স সাংবাদিকরা। তিনি ফোরামের সব সাংবাদিককে লেখালেখির উপর আরো জোর দিতে বলেন।
রিপোর্টারদের পেশাগত উন্নয়নের লক্ষে ফোরাম সাংবাদিকদের কর্মশালাসহ বিভিন্ন আয়োজন, চট্টগ্রামের ভাষা ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ফোরামের সব সদস্যকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়াসহ প্রতি বছর আনন্দ আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দেন ফোরাম সভাপতি।
টিআইবি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক শরীফুল ইসলাম রুকন সম্মাননার জবাবে বলেন, চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স ফোরাম আজ আমাকে যে সম্মান দেখালো তাতে আমার লেখালেখির উৎসাহ আরো বেড়ে যাবে। ফোরামের সভাপতি কাজী আবুল মনসুরের কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে সুদূর গ্রাম থেকে এনে হাতে কলমে সাংবাদিকতা করতে সাহস জুগিয়েছেন। আমাকে আলোকিত বাংলাদেশ ও প্রতিদিনের সংবাদে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে আমি এতদূর আসতে পেরেছি। আজকে টিআইবি পুরস্কার প্রাপ্তির পেছনে ওনার অবদান আমি কোনদিন ভুলব না।
চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স ফোরাম সারা দেশে কলম সৈনিকদের আস্থার জায়গা হয়ে উঠছে জানিয়ে সাধারণ সম্পাদক আলীউর রাহমান বলেন, ফোরাম গঠন করার পর থেকে নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হলেও সব সমস্যাকে দূরে ঠেলে ফোরাম এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী আবুল মনসুর চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের আইকন। ওনার হাত ধরে অনেকে সাংবাদিকতা জগতে এসেছে। আগামীতে সাংবাদিকদের পেশাগত উন্নয়নের দিকে ফোরাম নজর দেয়া ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সাথে ফোরাম যৌথভাবে কাজ করবে বলে জানান ফোরাম সাধারণ সম্পাদক।
আয়োজন কমিটির আহবায়ক লোকমান চৌধুরী বলেন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে এ আয়োজনটি করতে হয়েছে। হয়ত নানা ভুলত্রুটি থাকতে পারে। আপনারা সবকিছু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
দুপুর প্রায় দেড়টা। আলোচনা পর্ব শেষেই শুরু হয় ভুড়িভোজ। সাজানো টেবিলে নানা পদের খাবার। মেন্যুতে ছিল সালাদ, রূপচাঁদা মাছ ফ্রাই, ডিম কারী, মেজবানী গোস্ত ও খাসি এবং মেজবানী ডাল। এ পর্বে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করে উপমহাদেশীয় মৃৎশিল্পের প্রাচীন একটি উপাদান মাটির শানকিতে (বাসন) খাবার পরিবেশন।
দুপুরের খাবার পর্ব শেষে আবারো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পালা। এসময়ে সুরের মূর্ছনায় মেতে ওঠে নিরিবিলি পর্যটন কেন্দ্রের চত্বরসহ আশপাশের এলাকা। গান ও নৃত্যের জমজমাট সমাহার মুগ্ধতা ছড়ায় দর্শক-শ্রোতাদের মনে। জনপ্রিয় সব গানে আসর মাতান শিল্পী মুজাহিদ, আঁখি, জেরিন ও চ্যানেল আই সেরা কন্ঠের জুয়েলদ্বীপ। এছাড়াও আরো গান পরিবেশন করেন সিআরএফের ক্রীড়া সম্পাদক সাইফুল্লাহ চৌধুরী ও সদস্য অনুজ দেব বাপু।
যাঁরা অংশ নিয়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিনভর বর্ণাঢ্য আয়োজনের সমাপ্তি ঘটান ফোরামের সহ সভাপতি আলমগীর অপু। তিনি বলেন, আজকের দিনটি ফোরামের জন্য আমাদের ছেড়ে দিয়েছে পার্ক কমিটি যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তিনি পার্কের ব্যবস্থাপনা কমিটি, আয়োজক কমিটি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আসা শিল্পীদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
বিদায় নেয়ার আগে মিলনমেলায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য আবারো ছিল চমক। দুটি প্যাকেটে সবার হাতে তুলে দেয়া হয় আকর্ষণীয় সব উপহার।
সূর্য অনেক আগেই হেলে পড়েছে পশ্চিমের দিকে। বিকেল প্রায় সাড়ে চারটা। একটু পরেই নিভে যাবে আলো। বিদায় নেবে ২০২৩ এর শেষ দিবসের শেষ সূর্য…। অন্যদিকে, আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কয়েকঘণ্টার মিলনমেলা ভেঙে সবার বিদায় নেয়ার পালা। গন্তব্যে ফেরার আগে ফোরামের সদস্যদের কন্ঠেও তাই রাবীন্দ্রিক সুর- যখন ভাঙল মিলন মেলা / ভেবেছিলুম ভুলব না আর চক্ষের জল ফেলা / দিনে দিনে পথের ধুলায় মালা হতে ফুল ঝরে যায়…।
Discussion about this post